দশমহাবিদ্যা হল ভগবতী সতীর দশ মহাশক্তির রূপ।
এই দশটি রূপ —
১) কালী ২) তারা ৩) ষোড়শী ৪) ভুবনেশ্বরী ৫) ভৈরবী ৬) ছিন্নমস্তা ৭) ধূমাবতী ৮) বগলা ৯) মাতঙ্গী ১০) কমলা।
দশমহাবিদ্যার মন্ত্র —কালীরূপং মহেশানি সাক্ষাৎ কৈবল্যদায়িনী॥
১তারকত্বাৎ সদাতারা তারিণী চ প্রকীর্তিতা॥
২শ্রীদাত্রী চ সদা বিদ্যা ষোড়শী পরিকীর্তিতা॥
৩ভৈরবী দুঃখহন্ত্রী চ যমদুঃখ বিনাশিনী॥
৪ভুবনানাং পালকত্বাৎ ভুবনেশী প্রকীর্তিতা॥
৫ত্রিশক্তি কালদা দেবী ছিন্না চৈব সুরেশ্বরী॥
৬ধূমরূপা মহাদেবী চতুর্বগপ্রদায়িনী॥
৭ব-কারে বারুণীদেবী গ-কারে সিদ্ধিস্মৃতা।ল-কারে পৃথিবী চৈব চৈতন্য মে প্রকীর্তিতা॥ ৮সর্বাপত্তারিণী দেবী মাতঙ্গী করুণাময়ী॥
৯বৈকুণ্ঠবাসিনী দেবী কমলা ধনদায়িনী॥
১০এতেঃ দশমহাবিদ্যাঃ সিদ্ধবিদ্যাঃ প্রকীর্তিতঃ॥দশমহাবিদ্যা পূজার বিধি-নিষেধ —দশমহাবিদ্যার দেবীদের পৃথক পৃথক ভৈরব আছেন। দেবীদের পূজার সময় তাঁদের ভৈরবদেরও পূজা করতে হয় দেবীমূর্তির ডান দিকে। ১>কালিকার ভৈরব মহাকাল। ২> তারার ভৈরব অক্ষোভ্য ৩> ষোড়শীর পঞ্চাননশিব। ৪> ভুবনেশ্বরীর ত্র্যম্বক। ৫> ভৈরবীর দক্ষিণামূর্তি। ৬> ছিন্নমস্তার কবন্ধশিব। ৭> বগলামুখীর একবক্ত্র মহারুদ্র। ৮> মাতঙ্গীর মতঙ্গশিব। ৯> কমলার বিষ্ণুরূপী সদাশিব।১০> ধূমাবতী এই দশমহাবিদ্যামূর্তির একত্র পূজা সচরাচর হয় না। আলাদা আলাদা করে বিশেষ পর্বে পূজা হয় বিভিন্ন দেবীমূর্তির। তবে কালীপূজা ও কমলা পূজার চলই বেশী গৃহস্থ বাড়িতে। গৃহস্থ বাড়িতে অন্যসব দেবীমূর্তির পূজা করা ঠিক না। পূজা ঠিক মতো না হলে প্রত্যবায় হয়। প্রথম মহাবিদ্যা — কালী।“একি ভয়ঙ্করী, করালবদনা, লোলজিহ্বা, রুধিরমগনা। গলিত রুধির মুণ্ডমালা গলে বিলম্বিত॥মহামুণ্ড করে রক্তস্রোত ঝরে। খড়্গ ধরে ভাসে রক্তধারে॥বরাভয় দ্বিভুজ দক্ষিণে।বিবসনা বিকটদশনা, ত্রিনয়না, চন্দ্রখণ্ড শোভে ভালে !”॥ ইনি প্রথম মহাবিদ্যা কালী।
দেবী নিজে একবার তাঁর এই কালীমূর্তির প্রাধান্যের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন —“সর্বাসাং সিদ্ধবিদ্যানাম্ প্রকৃতির্দক্ষিণ।”ইনিই সমস্ত সিদ্ধবিদ্যাদেবীদের প্রধান। এই দেবী কালীর একটি ছোট ধ্যানমন্ত্র —“মেঘাঙ্গীং বিগতাম্বরাং শবশিবারূঢ়াং ত্রিনেত্রাং পরম্। কর্ণালম্বিত শবযুগ্মভয়দাং মুণ্ডস্রজাং মালিনীং॥ বামাধোর্ধ্ব করাম্বুজে নরশিরঃ খড়্গঞ্চ সব্যেতরে।দানাভীতি বিমুক্তকেশনিচয়াং বন্দে সদা কালিকাম্॥ অন্যান্য মহাবিদ্যাগণ এই কালিকারই নানা রূপভেদ মাত্র। কলৌ কালী কলৌ কালী নান্যদেব কলিযুগে। শ্রীআদ্যা কালিকামন্ত্রাঃ সিদ্ধমন্ত্রাঃ সুসিদ্ধিদাঃ।” কলিযুগে কালী ভিন্ন অন্য কোন দেবদেবী নাই। কালিকামন্ত্রই সর্বসিদ্ধি প্রদান করে। এই কালীর উৎপত্তি নিয়ে আরও নানা কাহিনী নানা পুরাণে আছে। একমতে আনি দারুকাসুরকে বধ করবার জন্য ব্রহ্মার প্রার্থনাতে তাঁর দেহের ষোলো ভাগের এক ভাগ শিবের শরীরে প্রবেশ করান। শিবের কণ্ঠের বিষের নীলবর্ণে তাঁর শরীর নীল হয়ে তিনি শিবের ললাটস্থ ত্রিনেত্র থেকে বাইরে আসেন। তাঁর দেহও নীল হয়। হাতে শিবেরই মতো আয়ুধ, ত্রিনেত্রা-চন্দ্রশেখরা। তিনি দারুকাসুরকে বধ করেন যে রূপে, তাঁর সেই সময় নাম হয় কালী। আবার শুম্ভ-নিশুম্ভকে বধ করবার সময় দেবী পার্বতীর শরীরকোষ থেকে কৌশিকী দেবীর সৃষ্টি হলে মূল দেবী পার্বতী কৃষ্ণবর্ণা কালী হয়ে যান। এই দেবীমাহাত্ম্য গ্রন্থের ঐ পর্বেই দেখা যায় চণ্ডমুণ্ডকে বধ করবার সময় কৌশিকী দেবীর ললাট ফলক্ থেকে এক ভীমা ভয়ঙ্করী দেবীর আবির্ভাব হয়। দেবীর কোপসমুদ্ভূতা সেই দেবীও কৃষ্ণবর্ণা, বিচিত্র আয়ুধধারিণী রুদ্রাণী মূর্তিতে চণ্ডমুণ্ডকে বধ করেন। সেই আদ্যা কালীই পরে চামুণ্ডা নাম প্রাপ্ত হন।দ্বিতীয় মহাবিদ্যা — তারা।
কালীর পরে যে মূর্তির দর্শন পান মহাদেব, তিনি তারা। তাঁর মূর্তির বর্ণনা —“নীলবর্ণা লোলজিহ্বা করালবদনা। সর্পবান্ধা ঊর্ধ্ব একজটা-বিভূষণা॥ অর্ধচন্দ্র পাঁচখানি শোভিত কপাল। ত্রিনয়নী লম্বোদরী পরা বাঘছাল॥ নীলপদ্ম খড়্গ ছুরি সমুণ্ড খর্পর।চারিহাতে শোভে- আরোহণ শিবোপর॥ ”ইনি জীবকে বাক্শক্তি প্রদান করেন, তাই এঁর নাম নীল সরস্বতী, সকল জীবকে উদ্ধার-তারণ করেন, তাই ইনি তারিণী তারা। এঁর উৎপত্তি সম্বন্ধে বলা হয়েছে, চৈত্র মাসের শুক্লা নবমীতে কালরাত্রির দিনে স্বয়ং উগ্র আপদ থেকে জীবকে তারণ করেন, তাই ইনি উগ্রতারা। মেরুর পশ্চিমকূলে চোল বলে এক হ্রদে মায়ের আবির্ভাব। ত্রিযুগ ধরে ইনি সেখানে তপস্যা করেন, তারা সত্বগুণাত্মিকা তত্ত্ববিদ্যাদায়িনী। তন্ত্রমতে-তাঁর ধ্যানমন্ত্র —“প্রত্যালীড় পদাং ঘোরাং মুণ্ডমালা-বিভূষিতাম্। খর্বাং লম্বোদরীং ভীমাং ব্যাঘ্রচর্মাবৃতা কটৌ॥নবযৌবনসম্পন্নাং পঞ্চমুদ্রা বিভূষিতাম্। চতুর্ভুজাং লোলজিহ্বাং মহাভীমাং বরপ্রদাম্॥খড়্গ কর্ত্রী সমাযুক্ত সব্যেতর ভুজদ্বয়াম্। কপাল উৎপল সংযুক্ত সব্যপানিদ্বয়ান্বিতাম্॥পিঙ্গোগ্রৈকজটা ধ্যায়েৎ। মৌলী অক্ষোভ্য-ভূষিতাম্॥জ্বলচ্চিতামধ্যগতাম্ ঘোরদংষ্ট্রাং করালিনীং। সাবেশস্মের বদনাং স্ত্র্যলঙ্কারভূষিতাম॥বিশ্বব্যাপক তোয়ান্তঃ শ্বেতপদ্মোপরিস্থিতাম্। অক্ষোভ্য দেবীমূর্ধণ্যস্ত্রিমূর্তি নাগরূপধৃক॥” তিনি বামচরণখানি সামনে নিয়ে দক্ষিণ চরণ পেছনে রেখে দণ্ডায়মানা, ভীষণদর্শনা-মুণ্ডমালা বিভূষিতা, খর্বাকৃতি, লম্বোদরী, কটিতে ব্রাঘ্রচর্ম। নবযৌবনা, লেলিহানাদি পঞ্চমুদ্রাধারিণী। চতুর্ভুজা, লোলজিহ্বা। মহাভয়ঙ্করী বরদাত্রী। তাঁর দক্ষিণ দুই হাতে খড়্গ ও ছোট কাতারী। বাম দুই হাতে নরকপাল ও নীল পদ্ম। মাথায় পিঙ্গলবর্ণের দীর্ঘ একটি জটা ও তাতে নাগরূপধারী অক্ষোভ্য ঋষি। জ্বলন্ত চিতা চারিপাশে। তাঁর দন্তপংক্তি অতি ভয়ানক। তিনি ভীষণা অথচ মধুর হাস্যবদনা। নানা অলঙ্কারে বিভূষিতা এই দেবী জগৎব্যাপী কারণ সলিলে শ্বেতপদ্মের ওপর দণ্ডায়মানা। ইনিই তারা বিদ্যা।
তৃতীয় মহাবিদ্যা — ষোড়শী।তারার পরে যিনি মহাদেবকে দর্শন দিলেন তিনি ষোড়শী। ইনি ত্রিপুরসুন্দরী, ত্রিপুরা ভৈরবী, রাজরাজেশ্বরী, ত্রিকুটাদেবী, শ্রীবিদ্যা। তন্ত্রশাস্ত্রমতে ইনি অপরূপা দিব্য সৌন্দর্যের অধিশ্বরী। ইনি রজঃগুণ প্রধানা ও সত্ত্বগুণাত্মিকা — এঁর রূপ মহাদেবের দৃষ্টির সামনে ধরা দিয়েছিল এক সুন্দরী ষোড়শী যুবতীর মূর্তিতে।এঁর ধ্যানমূর্তি —“বালার্কমণ্ডলাভাসাং চতুর্বাহুং ত্রিলোচনাম্ পাশাঙ্কুশ বরাভীতি ধায়ন্তীং শিবাংশ্রয়ে।”উদীয়মান সূর্যের মতো রক্তবর্ণ যাঁর গায়ের রং, চতুর্ভুজা, ত্রিনয়না, চারহাতে পাশ, অঙ্কুশ ও ধনুর্বাণ ধারণ করে আছেন যিনি সেই শিবানীই সকলের আশ্রয়। তিনি বসে আছেন একটি রক্তপদ্মের ওপর। সেই পদ্মটি আবার এক অর্ধশায়িত মহাদেবের নাভি থেকে উঠে এসেছে। এই বিগ্রহের তিনটি স্তর। সর্বনিম্ন স্তরে একসারি দেবতা করজোড়ে ধ্যানরত। ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর-পঞ্চানন ও রুদ্রদেব। নিজেরই শরীরজাত পদ্মাসনে দেবীকে উপবিষ্টা দেখে ও তাঁর পদতলে ব্রহ্মাদি পঞ্চদেবতাকে স্তুতিরত দেখে শিব স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। এই ষোড়শীর সৃষ্টি সম্পর্কে নারদপঞ্চরাত্রে এক অপূর্ব কাহিনী আছে। ইনি জগৎকে শ্রী দান করেন তাই ইনি শ্রীবিদ্যা মহাদেবী ত্রিগুণাতীতা। তাই তাঁর নাম ষোড়শী।কীভাবে মহামায়া কালিকা সৌন্দর্যময়ী হয়েছিলেন তার বর্ণনায় বলেছেন, একসময় মহাদেব যখন কৈলাসে বসবাস করছেন তাঁর ঘরণী অসিতা মহাদেবীকে নিয়ে, সেই সময় দেবরাজ ইন্দ্র কোনো কারনে অপ্সরাদের পাঠালেন মহাদেবের কাছে তাঁর বন্দনা করবার জন্য। যোগীশ্বর, যোগেশ্বর মহাদেব ইন্দ্রের এই কীর্তি বুঝতে পেরে অপ্সরাদের বললেন, “পুরুষের অতিথি পুরুষ, আর স্ত্রীলোক স্ত্রীলোকের অতিথি। এই জন্য তোমরা আমার গৃহিণী দেবী কালিকার কাছে যাও।” এই বলে তাদের সঙ্গে করে অন্দরমহলে মায়ের কাছে নিয়ে গিয়ে তাঁকে ‘কালী’ বলে সম্বোধন করে এদের পরিচয় দিলেন। মহাদেবী এইভাবে বাইরের লোকের সামনে তাঁকে কালী বলে ডাকায় খুবই ব্যথিত হলেন। ঘরে তাঁকে কালো রং-এর জন্য কালী বলা সহ্য করা যায়, কিন্তু তাই বলে বাইরের লোকের সামনে এই ভাবে কালী বলায় তিনি খুবই অপমানিত বোধ করে ভাবলেন, ‘আমি তপস্যা করে এই কালো রূপের আবরণ সরিয়ে শুদ্ধ গৌরী রূপ ধারণ করে মহাদেবের চোখ ধাঁধিয়ে দেব।’ এই ভেবে তিনি অন্তর্ধান করলেন।মহাদেব কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে দেবীকে দেখতে না পেয়ে সেইখানেই বসে তাঁর ধ্যান করতে লাগলেন। এই সময়ে সব গোলমাল পাকানো নারদ সেখানে এসে হাজির হলেন। নারদ একথা-সেকথার পর দেবী কোথায় আছেন জানতে চাইলে তিনি বললেন “দেবী আমাকে ছেড়ে অভিমান করে কোথায় চলে গিয়েছেন।” নারদ এই কথা শুনে ঝগড়া লাগাবার একটা সূত্র পেয়ে মনে মনে খুব খুশি হয়ে ধ্যান করে জানতে পারলেন দেবী সুমেরু পর্বতের দিকে গিয়ে তপস্যা করছেন। নারদ শিবকে প্রণাম করে তখনই দেবীর তপস্যাস্থলে হাজির হয়ে তাঁকে প্রণাম করে কুশল প্রশ্ন করলেন।দেবী তাঁকে পাল্টে জানতে চাইলেন, “আমাকে ছেড়ে মহাদেব কেমন আছেন ? তিনি ভালো আছেন তো ?” দূরে গেলেও পতির চিন্তাতে মহামায়া উদ্বিগ্নই ছিলেন। নারদ কিন্তু উল্টোসুর ধরলেন। তিনি বললেন — “আপনাকে ছেড়ে তিনি ভালোই আছেন। অন্য কোনো দেবীর চিন্তায় তিনি মগ্ন হয়ে আছেন। আপনি শিগ্গির সেখানে গিয়ে তাঁকে সামলান।” এই কথা শুনে দেবী দারুন রেগে গেলেন ও এক অপরূপা মূর্তি ধারণ করলেন, রাগে তাঁর সর্বাঙ্গ রক্তবর্ণ হয়ে গেল। ত্রিলোকে এমন সুন্দরী আর নেই। সেই দিব্য সৌন্দর্যে শোভিতা হয়ে তিনি চললেন কৈলাসে। “দেখাচ্ছি তোমাকে, আমার চেয়ে আর বেশি সুন্দরী তুমি কাকে ভাবছ ! ত্রিলোকে আর কেউ এমন পারে না।”এই দিব্য সৌন্দর্যে ত্রিজগৎ আলো করে মা এসে হাজির হলেন কৈলাসে ধ্যানরত শিবের কাছে। সেখানে তিনি গিয়ে অবাক হয়ে দেখলেন ধ্যানস্থ শিবের বুকে এক অনুপমা নারীমূর্তির ছায়া। এই দেখে মহাদেবী আরও রেগে গিয়ে শিবকে খুব নিন্দা করতে লাগলেন। “তুমি পত্নীর প্রতি অবিশ্বস্ত, ব্যভিচারী, অন্য রমণীর চিন্তায় মগ্ন। এই তোমার আমার সঙ্গে সম্পর্ক ?” দেবীর এই অভিমানপূর্ণ রূঢ় ভাষায় মহাদেব ধ্যান ভেঙে মৃদু হেসে দেবীকে বললেন “আমি কোনো অন্যায় তো করিনি। কোনো বিশ্বাসের সীমাও লঙ্ঘন করিনি। তুমি শুধু শুধু কেন আমার ওপর রাগ করছ ? একটু ভালো করে ছায়াটির দিকে লক্ষ্য কর আর নিজেকে দেখ। তাহলেই সব রহস্যের যবনিকাপাত হবে।” এই শিববাক্যে দেবী নিজের মূর্তির দিকে ভালো করে লক্ষ্য করে বুঝলেন শিবহৃদয়ে তাঁরই ছায়া মাত্র। নিশ্চিন্ত হলেন দেবী। তখন দেবী শিবকে প্রশ্ন করলেন, “আমার এই নতুন গৌরী মূর্তি, যার ছায়া তোমার হৃদয়ে তার পরিচয় কী হবে তুমিই বল ? তখন শিব বললেন, “হে শিবে ! তুমি ত্রিভুবনে শ্রেষ্ঠ রূপ ধরেছিলে, সেজন্য স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতালে তোমার তুলনা তুমিই হবে। তোমার নাম হবে ত্রিপুরসুন্দরী। তুমি হবে অটুটযৌবনা-সদা ষোড়শবর্ষীয়া, তাই তোমার নাম হবে ষোড়শী।আজ আমার হৃদয়ে তুমি তোমারই ছায়া দেখে ভীতা হয়েছিলে সেজন্য তিনলোকে তুমি ত্রিপুরভৈরবী বলে খ্যাত হবে। তুমি সর্বসৌন্দর্যময়ী, সকল ঐশ্বর্যের অধিশ্বরী, তাই তোমাকে সাধকেরা বলবেন রাজরাজেশ্বরী। তুমি জগতের সমস্ত বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী দেবী, তাই তোমার নাম হবে শ্রীবিদ্যা।” শিববচনে প্রসন্না হয়ে দেবী পরমানন্দে কৈলাসে শিবসঙ্গে বিরাজ করতে লাগলেন।
চতুর্থ মহাবিদ্যা — ভুবনেশ্বরী। মহাদেব কালী ও তারা মূর্তির ভয়ঙ্করী রূপ দর্শনে সন্ত্রস্ত হওয়ার পরে কৃপাময়ী মা তাঁর প্রসন্না রাজরাজেশ্বরী মূর্তি দর্শন করিয়ে পতিদেবতাকে কিছুটা ধাতস্থ করবার পরে আরও দুটি তাঁর প্রসন্ন মূর্তি দর্শন করালেন। একটি ভুবনেশ্বরী। ইনি নানা নামে খ্যাত — ত্রিপুটা, জয়দুর্গা, বনদুর্গা, কাত্যায়নী, মহিষঘ্নী, দুর্গা, শূলিনী, মেধা, রাধা ইত্যাদি। এঁর মূর্তিও সুন্দর অভয়প্রদা।“বালরবিদ্যুতিম্ ইন্দুকিরীটাম্। তুঙ্গকুচাম্, নয়ন-ত্রয়যুক্তাম্,॥ স্মেরমুখীং, বরদাঙ্কুশ পাশঅভীতি। করাম্ প্রভজে ভুবনেশীম্॥”নবোদিত সূর্যতুল্য প্রভাময়ী। চন্দ্র যাঁর মুকুটমণি রূপে বিরাজিত, যাঁর বক্ষস্থল উন্নত, সদা স্নেহপীযূষধারায় পরিপূর্ণ, ত্রিনয়নী-চতুর্ভুজে বরাভয় ও পাশ, অঙ্কুশধারিণী কমলাসনা সেই দেবী ভুবনেশ্বরীকে ধ্যান প্রণত হই। — এই ধ্যানমন্ত্রে তাঁর পূজা হয়। ইনি ষোড়শীর অপর মূর্তি, তাই এঁর প্রকটকাল আলাদা করে কিছু বলা হয়নি।পঞ্চম মহাবিদ্যা — ভৈরবী। দেবী নিজের ছায়া শিবের হৃদয়ে দেখে ভয় পেয়েছিলেন বলে ও স্বয়ং ভৈরব মহাদেবের প্রাণসমা-প্রিয়া আত্মশক্তি বলে এঁকে ত্রিপুরাভৈরবী বলা হয়েছে। ইনি জীবের যমদুঃখ নাশ করেন। এঁরও রূপ সুন্দর, তবে তারসঙ্গে কিছুটা ভীতিসঞ্চারকারী। এঁর ধ্যানে বলা হয়েছে —“উদ্যৎ ভানু সহস্রকান্তি, অরুণক্ষৌমাং,শিরো-মালিকাং, রক্তালিপ্ত পয়োধরাং জপবটীম্। বিদ্যাম্ অভীতিং করাম্। হস্তাব্জৈর্দধতীং ত্রিনেত্রবিলসদ্ বক্ত্রারবিন্দশ্রিয়াম্। দেবীং বদ্ধ হিমাংশু রত্নমুকুটাং বন্দে সুমন্দস্মিতাম্।উদীয়মান সূর্যের মতো এঁর গাত্রবর্ণ রক্তিম। রক্তবর্ণের পট্টবস্ত্র পরিহিতা। তাঁর করকমল চতুষ্টয়ে জপমালা, পুস্তক, বর ও অভয় মুদ্রা। বক্ষস্থল কণ্ঠের নরমুণ্ডমালার রক্তে রঞ্জিত। ত্রিনেত্রা, পদ্মের ন্যায় সুন্দর মুখ যাঁর। হাস্যবদনা দেবীর মাথায় জটায় চন্দ্রের শোভা তাঁর রত্নময় কিরীটে। পদ্মাসীনা এই দেবী ভৈরবীকে আমি প্রণাম করি। ইনি কালভৈরবের ভার্যা তাই ভৈরবী।ষষ্ঠ মহাবিদ্যা — ছিন্নমস্তা। ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী এই সব অভয়দা মূর্তি দর্শন করে মহাদেব যখন একটু স্বাভাবিক হচ্ছেন তখন আর এক দিকে পালাতে গিয়ে সেদিকে দেখছেন আর একজন ভীমা ভয়ঙ্করী দেবীমূর্তিকে- ইনি ছিন্নমস্তা। ইনি রজঃপ্রধানা সত্ত্বগুণাত্মিকা, এঁর ধ্যানমন্ত্র বিরাট। অতি সংক্ষেপে সেটি হচ্ছে —“প্রত্যালীঢ়পদাং সদৈব দধতীং ছিন্নং শিরঃ কর্তৃকাং।দিগ¦স্ত্রাং স্বকবন্ধশোণিতসুধাধারাং পিবন্তীং মুদা॥ নাগাবদ্ধ শিরোমণিং ত্রিনয়নাং হৃদ্যুৎপলালঙ্কৃতাং।রত্যাসক্তমনোভবোপরি দৃঢ়াং ধ্যায়েৎ জবাসন্নিভাম্॥অন্যমন্ত্রে, ভাস্বন্মণ্ডলমধ্যগতাং নিজশির-িন্নং বিকীর্ণালকং স্ফারাস্যং প্রপিবদ্গলাৎ স্বরুধিরং বামে করে বিভ্রতীম্। যাভাসক্তরতিস্মরো পরিগতাং সখ্যৌ নিজে ডাকিনী বর্ণিনৌ পরিদৃশ্যমোদকলিতাং শ্রীছিন্নমস্তাং ভজে।”মহাদেব দেখলেন কেমন এই ভয়ঙ্করী প্রচণ্ড চণ্ডিকা ছিন্নমস্তা দেবীকে। রক্তবর্ণা দেবী দাঁড়িয়ে আছেন একটি ত্রিকোণ যন্ত্রোপরি শায়িত এক মিথুনরত শরীরের উপরে পদ্মের উপর বাম পা সামনে দিয়ে। তিনি ছিন্নমস্তা-তাঁর বাঁ হাতে নিজের ছিন্নমুণ্ড ত্রিনেত্রা, বিস্তৃত লোলজিহ্বা তাতে। নিজের গলা থেকে নির্গত রক্তস্রোতধারা নিজের ছিন্নমুণ্ড পান করছে। সেই মুণ্ডের আলুলায়িত কেশরাশি ও কিরীটশোভিত। দিগম্বরী দেবীর ডানহাতে কাটারি, কণ্ঠে হাড়ের মালা ও সর্পের যজ্ঞোপবীত। সদা ষোড়শবর্ষীয়া দেবীর উন্মুক্ত বক্ষঃস্থল স্নেহপীযূষপূর্ণ। তাঁর বামে সখি ডাকিনী, দক্ষিণে বর্ণিনী-এঁরাও দিগম্বরী ও যথাক্রমে পীত ও রক্তবর্ণা। এরাও মুণ্ডকেশী, নাগযজ্ঞোপবীতধারিণী, অস্থিমাল্যধারিণী। এঁদেরও ডান পা সামনে বাড়ানো। এঁদেরও বামহাতে কপাল ও ডানহাতে কাটারি। এঁরা ঊর্ধ্বমুখী হয়ে দেবীর ছিন্নকণ্ঠ হতে উৎক্ষিপ্ত রুধিরধারা পান করছেন। এই নায়িকাদ্বয় পরিসেবিতা ভয়ঙ্করী দেবীরই অন্য নাম প্রচণ্ডচণ্ডিকা বা ছিন্নমস্তা। এই ছিন্নমস্তা দেবীর উদ্ভব সম্পর্কেও একটি কাহিনি এক পুরাণে আছে। নারদপঞ্চরাত্রের মতে, একদিন দেবী পার্বতী তাঁর দুই সহচরীদের নিয়ে মন্দাকিনীতে স্নান করতে গিয়েছিলেন। সেই সময় তাঁর মনে হঠাৎ কামনা জেগে ওঠে, তার ফলে তিনি অনুরাগে রক্তবর্ণা হন। তাঁর সহচরীদ্বয়ও এই সময় ক্ষুধার্ত হয়ে তাঁর কাছে খাদ্য প্রার্থনা করেন। দেবী তাঁদের কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলেন। বলেন বাড়ি গিয়ে খাওয়ার ব্যবস্থা করব। কিন্তু বারবার তারা ক্ষুধার কথা জানিয়ে প্রার্থনা করলে এই জয়া-বিজয়া-ডাকিনী-বর্ণিনী রূপে মায়ের দুপাশ থেকে বলতে লাগলেন, “মাতা ত্বং সর্বজগতাম্, মাতরং প্রার্থয়েৎ শিশুঃ মাতা দদাতি সর্বেষাম ভোজনাচ্ছাদনাদিকম্। অতস্তাং প্রার্থয়ে ভক্ষ্যং ভক্ষ্যর্থং করুণাময়ী।” তুমিই সকল জগতের মাতা। শিশু মায়ের কাছেই খাদ্য প্রার্থনা করে। হে কৃপাময়ী জননী, আজ তুমি আমাদের এই দারুণ ক্ষুধা দূর কর।”করুণাময়ী জননী তাদের এই প্রার্থনা শুনে হঠাৎ নিজের বাম নখাগ্র দিয়ে নিজেরই মস্তক ছিন্ন করে সেটি নিজের বামকরতলে ধারণ করলেন। ছিন্ন মস্তক ও কণ্ঠ থেকে ত্রিধারায় রক্তস্রোত প্রবাহিত হতে লাগল। বাম ও দক্ষিণ দিক থেকে নির্গত দুটি ধারা দুই সখি জয়া ও বিজয়ার ভয়ঙ্করী মূর্তি ডাকিনী ও বর্ণিনীর ঊর্ধ্বমুখ লেলিহান জিহ্বায় সংযোজিত হল। আর মধ্যধারাটি নিজ ছিন্ন মুখে পড়তে লাগল। এই ভাবে নিজ মুণ্ড ছিন্ন করে সখীদের পরিতৃপ্ত করেছিলেন বলে তাঁর নাম হল ছিন্নমস্তা। কী অপার করুণা মায়ের ! সন্তানদের ক্ষুধা তৃষ্ণা দূর করতে তিনি স্বেচ্ছায় সানন্দে নিজ মুণ্ড ছিন্ন করে নিজ রক্তে তাদের পরিতৃপ্ত করেন। আপাতদৃষ্টে রুদ্রাণী ভয়ঙ্করী মূর্তি হলেও এর পশ্চাৎপট ও তাৎপর্য অতন্ত করুণায় পরিমণ্ডিত।সপ্তম মহাবিদ্যা — মাতঙ্গী।ভয়ঙ্করী ছিন্নমস্তার মূর্তি দেখে শিব অন্য দিক দিয়ে পালাবার চেষ্টা করলে সেদিকেও আর এক মূর্তির আবির্ভাব হল। ইনি মাতঙ্গী। শিব দেখলেন এক অপূর্ব দেবী —“শ্যামাঙ্গীং শশিশেখরাং ত্রিনয়নাং রত্নসিংহাসনস্থিতাম্। বেদৈর্বাহুদণ্ডৈঃ অসিখেটকপাশাঙ্কুশধরাম্।”শ্যামবর্ণা অর্ধচন্দ্রধারিণী ও ত্রিনেত্রা। চারহাতে তরবারি, বর্শা (ঢাল), পাশ ও অঙ্কুশ ধারণ করে রত্নসিংহাসনে বসে আছেন। ইনি তমঃ প্রধানা।এই দেবীর উৎপত্তি বিষয়ে নারদপঞ্চরাত্রে বলা হয়েছে — এক সময় দেবী পার্বতী কৈলাসে শিবের ক্রোড়ে উপবিষ্টা আছেন। এমন সময় তাঁর বাপের বাড়ি থেকে মা মেনকা তাঁর নাতিকে-মৈনাক পর্বতের ছেলে ক্রৌঞ্চকে, কৈলাসে পাঠালেন তাঁর বাড়ির এক উৎসবে পার্বতী ও জামাই শিবকে নিমন্ত্রণ করতে। শিব পার্বতীকে বাপের বাড়ীতে পাঠিয়ে দিলেন। নিজে যাওয়ার কথা কিচ্ছু বললেন না। দেবী পার্বতী বাপের বাড়ীতে গিয়ে উৎসবানন্দে মেতে আছেন। এই সময় শিব এক শঙ্খব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে সেখানে হাজির হয়ে সব মেয়েদের ভালো ভালো শাঁখা দিতে লাগলেন। পার্বতী শাঁখা চাইলে তাঁকে দিলেন না। বললেন, তোমাকে ভালো শাঁখা দিতে পারি, তবে আমি যা দাম চাইব তাই দিতে হবে। পার্বতী তাতেই রাজি হলে শঙ্খকার খুব সুন্দর এক জোড়া শাঁখা দেবীর হাতে পরিয়ে দিতে দেবী বললেন — “আমি নগাধিরাজ হিমালয়কন্যা — বিখ্যাত পর্বত মৈনাক আমার ভাই। গণপতি প্রভৃতি আমার সন্তান, সর্বোপরি কৃপাসাগর দেবাদিদেব মহাদেব আমার স্বামী সেই আমার কাছে তোমার এই প্রস্তাব ! ত্রিজগতে আমাকে একথা বলতে কার শক্তি আছে? আমি তোমাকে অভিশাপ দেব।” কিন্তু হঠাৎ তাঁর মনে কী একটা সন্দেহ হল শঙ্খকারকে মুচকি মুচকি হাসতে দেখে। তখন দেবী চোখ বন্ধ করে একটু ধ্যান করতেই মহাদেবের লীলা ধরে ফেলে বললেন, “ঠিক আছে, আমাকেই পাবে যথাসময়ে।” পরে দেবী কিরাত বেশ ধরে শিব যেখানে সন্ধ্যা করছিলেন, সেই মানস সরোবরে গিয়ে হাজির হলেন কিরাতবেশী সখীদের সঙ্গে নিয়ে। রক্তবর্ণা রক্তবস্ত্র পরিধানা উদ্ভিন্নযৌবনা কিরাতরূপিণী দেবীকে দেখে শিব মুগ্ধ হলেন। তাঁকে বরণ করতে চাইলেন। দেবী তখন বললেন, “আমি চণ্ডালী, তপস্যার জন্য এখানে এসেছি। আমি দেবত্ব লাভ করতে চাই। আমার তপোবিঘ্ন করবেন না।” মহাদেব বললেন, “আমি দেবতা শিব, তপস্বীদের ফল আমিই দান করি। তুমি আমাকে খুশি করলে তোমাকে আমিই পার্বতীর মতো করে দিতে পারি।” তখন চণ্ডালবেশী দেবী মহাদেবকে প্রণাম করায় মহাদেব তাঁর হাত ধরলেন ও কাছে এনে বসালেন ও নিজে চণ্ডালরূপ ধারণ করে দেবীর সঙ্গে আনন্দে মগ্ন হলেন। দেবী তখন বললেন, “কোনোভাবেই আমি আপনাকে ছলনা করতে পারলাম না। আপনি জগৎপতি। আমার এই ছদ্মবেশ ধরে ফেলে আমাকে সঙ্গদানে কৃপা করলেন। এখন আমাকে বর দান করুন।” শিব বললেন, তুমি চণ্ডালিনীর বেশে আমার সঙ্গে মিলিত হয়েছ, তাই তমপ্রধানা তোমার শ্যামবর্ণা হবে। তোমার নাম হবে উচ্ছিষ্ট চাণ্ডালিনী, সব শক্তিপূজার শেষে তোমার পূজা না করলে সে পূজা সিদ্ধ হবে না। আর সেখানে আমার পূজার নাম হবে চণ্ডেশ্বর। আর এই রূপে তুমি হবে মাতঙ্গীনামা দেবী। কালিকা বগলা সর্বসিদ্ধবিদ্যার মতো তুমিও হবে মহাবিদ্যা।”এ প্রসঙ্গে আরও একটি তন্ত্রে বলা হয়েছে — কোনো এক সময় এক কদম্বকাননে সকল ভূত বশের জন্য মতঙ্গ বলে এক ঋষি দীর্ঘদিন তপস্যা করছিলেন। তাঁর তপস্যায় প্রসন্ন হয়ে দেবী আদ্যাশক্তি ত্রিপুরসুন্দরীর নেত্র থেকে অতুল তেজ সমুৎপন্না হয়ে এক অপরূপা শ্যামবর্ণা অম্বিকা-কালিকা দেবীর সৃষ্টি হল। তিনি মতঙ্গ মুনিকে সিদ্ধি দান করে রাজ মাতঙ্গী এই নামে খ্যাত হন।অষ্টম মহাবিদ্যা — ধূমাবতী।মাতঙ্গী মূর্তি দর্শন করে মহাদব কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে আবার যেই পালাবার পথ খুঁজছেন তখন আবার দেখলেন এক বিচিত্র দেবীকে।“ বিবর্ণা চঞ্চলারুষ্টা দীর্ঘা চ মলিনাম্বরা। বিমুক্তকুন্তলারুক্ষা বিধবা বিরলদ্বিজা। কাকধ্বজরথারূঢ়া বিলম্বিত পয়োধরা।শূর্পহস্তা অতিরুক্ষাক্ষী ধৃতহস্তা বরান্বিতা। ক্ষুৎ পিপাসার্দিতা নিত্যং ভয়দা-কলহাস্পদা।”এক কাকধ্বজরথে বসে থাকা দেবী যাঁর গায়ের রং ফ্যাকাসে। চঞ্চলা ক্রুদ্ধা দীর্ঘদেহা, মলিনবস্ত্র পরিহিতা স্বামীহীনা দন্তহীনা, শিথিলস্তনা নারীমূর্তিকে দেখলেন। তাঁর হাতে কুলো, চোখের দৃষ্টি অত্যন্ত তীব্র, অন্য হাতে কম্পমান বরমুদ্রা। ক্ষুধা তৃষ্ণায় তিনি সর্বদা কাতর, ভয়ঙ্করী এই মূর্তি কলহপ্রিয়া। এই দেবীকে দেখে শিব বিভ্রান্ত হয়ে গেলেন, তাঁর পত্নী সতীর জায়গায় এ কোন বৃদ্ধা জরাগ্রস্তা বিধবা কোপনস্বভাবা মূর্তি ! এই তমঃপ্রধানা দেবী হচ্ছেন ধূমাবতী। এঁরও সৃষ্টি সম্পর্কে এক পুরাণে বলা হয়েছে — একদিন কৈলাসে শিব বসে আছেন, এমন সময়ে তাঁর কোলে বসে থাকা গিরিজা বাচ্চা মেয়ের মতো বলে উঠলেন, আমার খুব ক্ষিধে পেয়েছে-শিগ্গির কিছু খেতে দাও।” এই কথা শুনে মহাদেব বললেন, “একটু অপেক্ষা কর তোমার খাওয়ার ব্যবস্থা করছি।” একটু পরেই দেবী আবার বললেন, “দাও, দাও, আমার যে খুব ক্ষিধে পেয়েছে।” শিব আবার বললেন, “লক্ষ্মীসোনা, একটু অপেক্ষা কর, এই দিচ্ছি।” দেবী তখন বললেন, হে জগন্নাথ দেরি করবার ক্ষমতা আমার আর নেই।” এই বলে শিবকেই তুলে নিয়ে নিজের মুখের মধ্যে ফেলে দিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর সারা শরীর থেকে ধোঁয়া (ধূম) বেরোতে লাগল। তখন মহাদেব তাঁর যোগশক্তিতে দেবীর শরীর থেকে বাইরে এসে বললেন —“পশ্য ভদ্রে মহাভাগে পুরুষো নাস্তি মাং বিনা।ত্বদন্যা বনিতা নাস্তি পশ্যত্বং জ্ঞানচক্ষুষা। বিধবাসি কুরু ত্যাগং শঙ্খসিন্দুরমেব চ।সাধব্যং লক্ষণং দেবী কুরু ত্যাগং পতিব্রতে। ধূম ব্যাপ্তশরীরাত্তু ততো ধূমাবতী স্মৃতা।” হে শোভনে, ধ্যানযোগে দেখ, আমা ছাড়া আর পুরুষ নেই আর তুমি ছাড়া কোন স্ত্রী নেই। কিন্তু আমাকে গ্রাস করে তুমি বিধবা হয়েছ, তাই সধবার চিহ্ন শাঁখা সিন্দুর, পতিব্রতার চিহ্ন তুমি ত্যাগ কর। আর সমস্ত শরীর ধূমে পূর্ণ হওয়ায় তোমার নাম হল ধূমাবতী।আর এক তন্ত্রের মতে বরা হচ্ছে দক্ষযজ্ঞে পতিনিন্দা শ্রবণে সতী দেহত্যাগ করেছিলেন নিজের দেহ থেকে কোপাগ্নি সৃষ্টি করে। সেই অগ্নিময় দেহ ধূমে পরিব্যাপ্ত হয়েছিল। সেই তিথিটি ছিল অক্ষয় তৃতীয়া-মঙ্গলবার সন্ধ্যাবেলায়। তাই তন্ত্রে বলে দেবী ধূমাবতীর সৃষ্টি —“প্রাপ্তে অক্ষয় তৃতীয়ায়াং জাতা ধূমাবতীশিবে। কালী-কালী কালবক্ত্রা ভৌমবারে নিশামুখে।” এই মূর্তি সর্বশত্রু“বিনাশিনী। আবার এক কবি বলেছেন, “বিমুক্ত কেশী বামা জীবদুঃখ বিনাশে/শ্রমক্লান্ত প্রাণী ক্লেশ, ঘুচাইতে রুক্ষবেশ বিধবার রূপে নিত্য সতীহোতা বিকাশে।” হাতে কুলো—তার বাতাসে জীবের সব বিপদ আপদ শত্রু সব দূর করে দেবেন তিনি। ভীতিপ্রদা মূর্তিও জীবের দুঃখনাশে সদা প্রস্তুত।নবম মহাবিদ্যা — বগলামুখী।দেবী সতীর ধূমাবতী মূর্তি দর্শনের পর ভীতসন্ত্রস্ত মহাদেব আবার চোখ ঢেকে “রক্ষা কর রক্ষা কর মহাদেবে” বলে পালাতে গিয়ে দেখলেন সে পথও রুদ্ধ করে বসে আছেন আর এক অভিনব দেবীমূর্তি,“মধ্যে সুধাব্ধিমণিমণ্ডপ রত্নবেদী সিংহাসনোপরিগতাং পরিপীতবর্ণাং। পীতাম্বরাভরণ মাল্য বিভূষিতাঙ্গীং দেবীং স্মরামি ধৃতমুদ্গর বৈরি জিহ্বাম্/জিহ্ববাগ্রমাদায় করেণ দেবীং, বামেন শত্র“ন্ পরিপীড়য়ন্তীম্। গদাভিঘাতেন চ দক্ষিণে ন পীতাম্বরাঢ্যাং দ্বিভুজাং নমামি। ”অমৃতসাগরের মধ্যে মণিমণ্ডপ, তার উপর রত্নবেদী, সেই বেদীতে সিংহাসন। সেই সিংহাসনে দেবী বগলা উপবিষ্টা। তাঁর গায়ের রং হলদে। হলদে রং-এর কাপড়, সেই রং-এর অলঙ্কার, মাল্যে তিনি বিভূষিতা। তিনি একহাতে অসুরের জিভ ও অন্য হাতে গদা ধারণ করে আছেন। বাম হাতে তিনি শত্রু অসুরের জিভ টেনে ধরে ডান হাতে তাকে গদা দিয়ে মারছেন। এই হলদে রং-এর কাপড় পরা হলদে রং-প্রিয়া দেবী বগলামুখীকে আমি পূজা—প্রণাম করি।ইনিই দেবী বগলামুখী। ইনিও তমোগুণ প্রধানা। ইনি জীবের দারিদ্র দুঃখরূপ অসুরের হাত থেকে জীবকে নিস্তার করেন। এই তন্ত্রোক্ত দেবীর কৃপায় জীবের জীবনের নানা অশুভ অশান্তি দূর হয়। এঁর অসুরের রং শ্যামল বর্ণের। এঁর উৎপত্তি সম্পর্কে স্বতন্ত্র তন্ত্রে সংক্ষেপে বলা হয়েছে — সত্যযুগে পৃথিবীর বিনাশের জন্য একবার প্রচণ্ড প্রলয়ঝড়ের উদ্ভব হয়েছিল, তাতে সৃষ্টিকর্তা বিষ্ণু খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তিনি আদ্যাশক্তি মহামায়ার শরণ নেন এই বিপদ থেকে ধরিত্রীকে রক্ষা করবার জন্য। ত্রিপুরাম্বিকা দেবী সেই তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে একটি হলুদ রং-এর হ্রদ সৃষ্টি করে তার মধ্যে এক মঙ্গলবারে চতুর্দশী তিথিতে বীর রাত্রির মধ্যযামে জলক্রীড়ায় নিজের রূপ সৃষ্টি করেন ও ধরিত্রীকে রক্ষা করেন—ইনি বিষ্ণুতেজোময়ী দেবী—বগলামুখী। ইনি তন্ত্রের বিখ্যাত শক্তি মূর্তি-এঁর নামের অর্থ ব-কারে বারুণী দেবী, গ-কারে সিদ্ধিদায়িনী, ল-কারে পৃথিবী। ইনি পৃথিবীতে অসাধ্য-সাধনে অধিকারী। বগলামুখীর মন্ত্র জপ ও পুরশ্চরণে অসম্ভবও সম্ভব হয়। ঠিক ঠিক ক্রিয়াদি সম্পন্ন হলে পবনের গতি স্তব্ধ হয়, অগ্নি শীতল হয়, গর্বিতের গর্ব যায়, ক্ষিতিপতিও শংকিত হয়।দশম মহাবিদ্যা — কমলা।বগলামুখী মূর্তি দর্শনের পর মহাদেব এক অপূর্ব সুন্দরী মূর্তির দর্শন পেলেন —“কান্ত্যা কাঞ্চনসন্নিভাং হিমগিরি প্রখ্যৈশ্চতুর্ভি র্গজৈঃ। হস্তোৎক্ষিপ্ত-হিরন্ময়ামৃতঘটরাসিচ্যমানাং শ্রিয়ম্। বিভ্রানাং বরমব্জযুগ্মং অভয়ং হস্তৈঃ কিরীটোজ্জ্বলাং। ক্ষৌমাবদ্ধনিতম্ববিম্বললিতাং বন্দেঅরবিন্দস্থিতাম্।”ইনি দেবী কমলা দশমহাবিদ্যার শেষতম অবতার মহাবিদ্যা। এঁর গায়ের কাঁচা সোনার মতো রং-এ চতুর্দিক উজ্জ্বল। চারদিকে হিমালয়ের মতো চারটি বিরাট হাতি। তাদের শুঁড়ে ধরে রাখা কলস থেকে দেবীর মাথায় অমৃতবারিতে অভিষেক করা হচ্ছে। দেবীর চারটি হাতে দুটি পদ্ম ও বরাভয় মুদ্রা। মাথায় উজ্জ্বল রত্নমুকুট, পট্টবস্ত্র-পরিহিতা সুন্দর শরীর। রক্তবর্ণ কমলোপরি আসীনা দেবী কমলাকে আমি বন্দনা করি। ইনি মূর্তিমতী দয়া।এঁর উৎপত্তি বহুখ্যাত একটি ঘটনায় জানা আছে। প্রাচীনকালে সমুদ্র মন্থনকালে এঁর উৎপত্তি। ক্ষীরোদ সমুদ্রজাতা ইনি। বিষ্ণু তাঁকে তাঁর বক্ষঃস্থলে স্থান দেন। পদ্মাসনা এই দেবীকে তাই পদ্মা-পদ্মালয়া এই সব নানা নামে ভূষিত করা হয়। ইনি ভাদ্রমাসের কৃষ্ণাষ্টমী তিথিতে কোলাসুরকে বিনাশ করেন। এঁর আবির্ভাব ফাল্গুন মাসের একাদশী তিথি অথবা শুক্রবার বা মঙ্গলবারে যে তিথি হয় সেই তিথিতে সর্বসৌভাগ্যদায়িনী এই মহালক্ষ্মী দেবীর আবির্ভাব হয়। মহর্ষি দুর্বাসার অভিশাপে ইন্দ্রকে ও স্বর্গকে পরিত্যাগ করে ইনি সমুদ্রে আশ্রয় নেন। পরে দেবতা ও দৈত্যেরা সমুদ্রমন্থন করলে নানা মূল্যবান বস্তুর শেষে ইনি সমুদ্রের মধ্য থেকে উঠে এলে বিষ্ণু এঁকে গ্রহণ করে বৈকুণ্ঠে নিয়ে যান। স্বর্গ আবার লক্ষ্মীমন্ত হয়। ইন্দ্র তখন প্রণাম করে বলেন —“নমস্তে সর্বলোকানাম্ জননীং অব্ধি সম্ভবাম্। শ্রিয়মুন্নিদ্র পদ্মাক্ষীং বিষ্ণু বক্ষঃস্থলস্থিতাম্।”দেবী কমলাকে দর্শন করে শিব একটু স্বাভাবিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেই দেবীমূর্তি অন্তর্হিতা হলেন। শুধু শুনলেন তাঁর দৈববাণী — “তুমি কি ভুলে গেলে আগেকার সব কথা — সেই পরমা প্রকৃতি আমি প্রসবিনু, তুমি বিষ্ণু বিধি তিনজনে। তিন জনে তোমরা কারণ সলিলে ভেসে যাচ্ছিলে। আমি তোমাদের ‘তপ-তপ-তপ’ এই আদেশ করেছিলাম। তোমরা তিনজনে এই মন্ত্র জপ করতে লাগলে। সেই সময় আমি শবদেহ রূপে ভাসতে ভাসতে তোমাদের কাছে এসেছিলাম। শবের পচা গন্ধ বিষ্ণু সহ্য করতে না পেরে তপস্যা ভঙ্গ করে উঠে গেল। ব্রহ্মা সেই শবের দিক থেকে মুখ চারদিকে ঘুরিয়ে নিতে নিতে চতুর্মুখ হয়ে গেল। আর তুমি ঘৃণা না করে আমাকে আপন করলে। প্রকৃতি রূপেতে তোমা করিনু ভজন। পুরুষ হইলে তুমি আমার ভজনে। সেই তুমি সেই আমি ভেবে দেখ মনে।” দেবী আরও বললেন, “যার তরে একার্নবে শক্তির সাধন; তার কথা করি অযতন কোথা যাও মহেশ্বর।” —(মহাভাগবতপুরাণ)আত্মবিদ্ মহেশ্বর শক্তিতত্ত্ব উপলব্ধি করে তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে দেবীর দশটি বিগ্রহ স্মরণ করে তাঁকে দক্ষযজ্ঞে যাওয়ার অনুমতি দিয়ে রথ প্রস্তুত করতে নন্দীকে আদেশ দিলেন। আর সেই “রথে চড়ি গেলা সতী দক্ষের মন্দিরে।”.জয় মা . (সংগৃহীত)দশমহাবিদ্যা হল ভগবতী সতীর দশ মহাশক্তির রূপ।