দশমহাবিদ্যা মানে ভগবতী সতীর দশটি মহাশক্তির রূপ। এই রূপগুলি একদিকে করুণাময়ী, আবার অন্যদিকে ভয়ঙ্করী। এই দশ দেবী বিশ্বজগতের শক্তি, জ্ঞান, তপস্যা ও মুক্তির প্রতীক।
🔱 দশমহাবিদ্যার নামসমূহ
১️. কালী
২️. তারা
৩️. ষোড়শী (ত্রিপুরাসুন্দরী)
৪️. ভুবনেশ্বরী
৫️. ভৈরবী
৬️. ছিন্নমস্তা
৭️. ধূমাবতী
৮️. বগলামুখী
৯️. মাতঙ্গী
১️0. কমলা
🕉️ দশমহাবিদ্যা পূজার সাধারণ নিয়ম
- প্রতিটি দেবীর সঙ্গে এক ভৈরবের পূজাও করতে হয়।
- দেবীর ডান দিকে ভৈরবের স্থান।
- একসঙ্গে দশ মহাবিদ্যার পূজা সচরাচর হয় না।
- গৃহস্থ বাড়িতে সাধারণত কালী ও কমলা পূজা বেশি প্রচলিত।
- নিয়ম ভঙ্গ করলে প্রত্যাবায় (অশুভ ফল) হতে পারে।
⚫ প্রথম মহাবিদ্যা — কালী
- কালী হলেন আদি শক্তি, সময় ও মৃত্যুর দেবী।
- কালো দেহ, রক্তমাখা জিহ্বা, মুণ্ডমালা তাঁর অলঙ্কার।
- হাতে খড়্গ ও নরমুণ্ড — ধ্বংস ও মুক্তির প্রতীক।
- দেবী নিজে বলেছেন:
 “সর্বাসাং সিদ্ধবিদ্যানাম্ প্রকৃতির্দক্ষিণ।”
- কলিযুগে কালীর আরাধনাই সর্বোত্তম।
- তিনি শুম্ভ-নিশুম্ভ, চণ্ড-মুণ্ড প্রভৃতি অসুর বধ করে জগত রক্ষা করেন।
📿 ধ্যানমন্ত্র (সংক্ষিপ্ত)
“মেঘাঙ্গীং বিগতাম্বরাং… বন্দে সদা কালিকাম্॥”
🔵 দ্বিতীয় মহাবিদ্যা — তারা
- তারা দেবী নীলবর্ণা, ভয়ঙ্করী ও দয়াময়ী।
- তিনি জীবকে বাকশক্তি ও উদ্ধারশক্তি দেন।
- তাঁর আরেক নাম “নীল সরস্বতী” ও “তারিণী তারা”।
- বাঘচর্ম পরিহিতা, শিবের উপর আরোহিতা।
- হাতে খড়্গ, খর্পর, পদ্ম ও ছুরি।
- তিনি জীবকে অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে পার করান।
📿 ধ্যানমন্ত্র (সংক্ষেপে)
“প্রত্যালীড় পদাং ঘোরাং… বিশ্বব্যাপক তোয়ান্তঃ শ্বেতপদ্মোপরিস্থিতাম্॥”
🌸 তৃতীয় মহাবিদ্যা — ষোড়শী (ত্রিপুরাসুন্দরী)
- দেবী সৌন্দর্য, প্রেম ও সমৃদ্ধির প্রতীক।
- ত্রিপুরাসুন্দরী, ত্রিপুরাভৈরবী, রাজরাজেশ্বরী নামেও পরিচিত।
- রক্তবর্ণ গাত্র, চার হাত — হাতে ধনুক, বাণ, পাশ ও অঙ্কুশ।
- পদ্মাসনা, শিবের নাভি থেকে উদ্ভূত পদ্মে বিরাজমান।
- তিনি ষোড়শী, কারণ তিনি চিরযৌবনা ষোলো বছরের কন্যারূপে প্রকাশিত।
📿 ধ্যানমন্ত্র
“বালার্কমণ্ডলাভাসাং চতুর্বাহুং ত্রিলোচনাম্॥”
🕊️ চতুর্থ মহাবিদ্যা — ভুবনেশ্বরী
- জগতের পালনকর্ত্রী।
- রূপে কোমল, মাধুর্য ও করুণার প্রতিমূর্তি।
- নবোদিত সূর্যের মতো উজ্জ্বল, ত্রিনয়না, চতুর্ভুজা।
- হাতে বর, অভয়, পাশ ও অঙ্কুশ।
- তিনি সংসারের ভারসাম্য রক্ষা করেন।
📿 ধ্যানমন্ত্র
“বালরবিদ্যুতিম্ ইন্দুকিরীটাম্… প্রভজে ভুবনেশীম্॥”
🔥 পঞ্চম মহাবিদ্যা — ভৈরবী
- ভৈরবীর রূপ শান্ত অথচ শক্তিশালী।
- তিনি যমদুঃখ নাশিনী।
- লালবর্ণা, হাতে জপমালা ও পুস্তক, বর ও অভয় মুদ্রা।
- মুখে কোমল হাসি, ত্রিনয়না, শিরে চন্দ্র।
- তাঁর ভৈরব হলেন কালভৈরব।
📿 ধ্যানমন্ত্র
“উদ্যৎ ভানু সহস্রকান্তি… বন্দে সুমন্দস্মিতাম্॥”
🩸 ষষ্ঠ মহাবিদ্যা — ছিন্নমস্তা
- ভয়ঙ্কর রূপে দয়াময়ী দেবী।
- নিজ মস্তক ছিন্ন করে নিজের রক্তে সখীদের তৃপ্ত করেন।
- এর মাধ্যমে ত্যাগ ও মাতৃস্নেহের চূড়ান্ত রূপ প্রকাশ পায়।
- রক্তবর্ণা, ত্রিনেত্রা, দিগম্বরা, হাতে খড়্গ ও মুণ্ড।
- সঙ্গে থাকেন দুই সখী ডাকিনী ও বর্ণিনী।
📿 ধ্যানমন্ত্র (সংক্ষিপ্ত)
“প্রত্যালীঢ়পদাং… ধ্যায়েৎ জবাসন্নিভাম্॥”
🌿 সপ্তম মহাবিদ্যা — মাতঙ্গী
- তিনি উচ্ছিষ্ট চাণ্ডালিনী, জ্ঞানের দেবী।
- তমোগুণ প্রধানা, কিন্তু তপস্যা ও সাধনার শক্তি প্রদান করেন।
- শ্যামবর্ণা, চার হাতে তরবারি, ঢাল, পাশ ও অঙ্কুশ।
- তিনি দেবী ত্রিপুরাসুন্দরীর তেজ থেকে জন্মগ্রহণ করেন।
- সকল পূজার শেষে মাতঙ্গীর পূজা না করলে সেই পূজা অসম্পূর্ণ থাকে।
📿 ধ্যানমন্ত্র
“শ্যামাঙ্গীং শশিশেখরাং… রত্নসিংহাসনস্থিতাম্॥”
🌫️ অষ্টম মহাবিদ্যা — ধূমাবতী
- ধূমাবতী হলেন বিধবার রূপে চিরসতী।
- রূপে বৃদ্ধা, মলিনবস্ত্রা, কাকরথযাত্রী।
- জীবের দুঃখ ও অভাব দূর করেন।
- হাতে কুলো, যা দিয়ে সব অশুভ বাতাস উড়িয়ে দেন।
- তিনি সংসারের মায়া ও আসক্তি ত্যাগের শিক্ষা দেন।
📿 উৎপত্তি কাহিনি:
ক্ষুধার্ত সতী শিবকে গিলে ফেললে, শিব যোগে বেরিয়ে আসেন এবং বলেন —
“তুমি বিধবা, তব নাম হবে ধূমাবতী।”
⚔️ নবম মহাবিদ্যা — বগলামুখী
- হলুদবর্ণা দেবী, দারিদ্র ও শত্রু বিনাশিনী।
- তিনি শত্রুর জিভ টেনে ধরে স্তব্ধ করেন, গদা দিয়ে আঘাত করেন।
- রূপে পীতবর্ণা, হাতে গদা ও বরমুদ্রা।
- জীবনের সব অশুভ শক্তি নষ্ট করেন।
- তাঁর উপাসনা করলে মনোবাসনা সিদ্ধ হয়, দুঃশক্তি নিবারণ হয়।
📿 ধ্যানমন্ত্র
“মধ্যে সুধাব্ধিমণিমণ্ডপ… পীতাম্বরাঢ্যাং নমামি॥”
💰 দশম মহাবিদ্যা — কমলা (মহালক্ষ্মী)
- কমলা হলেন সৌভাগ্য, সমৃদ্ধি ও করুণার প্রতীক।
- সোনালি দেহ, চার হাতে পদ্ম ও বরাভয় মুদ্রা।
- চার দিক থেকে হাতিরা অমৃতধারা বর্ষণ করছে।
- ক্ষীরসাগর থেকে সমুদ্র মন্থনের সময় তাঁর আবির্ভাব।
- তিনি বিষ্ণুর বক্ষস্থলে স্থান পান এবং বৈকুণ্ঠে বিরাজমান।
📿 স্তোত্র
“নমস্তে সর্বলোকানাম্ জননীং অব্ধি সম্ভবাম্॥”
🪔 দশমহাবিদ্যার মূল শিক্ষা
ভৈরবী শেখান ধ্যান ও দৃঢ়তার শক্তি।
প্রতিটি দেবী জীবনের এক একটি শক্তি ও অভিজ্ঞতার প্রতীক।
কালী শেখান ধ্বংস ও পুনর্জন্মের সত্য।
তারা দেন মুক্তি ও বাকশক্তি।
ষোড়শী শেখান সৌন্দর্য ও আত্মজ্ঞান।
ভুবনেশ্বরী ও কমলা দেন ঐশ্বর্য ও শান্তি।
ছিন্নমস্তা ও ধূমাবতী শেখান ত্যাগ ও বর্জনের শক্তি।
বগলা ও মাতঙ্গী জ্ঞান, বাক ও জয়প্রাপ্তির প্রতীক।
 
