আমলকী একাদশী হিন্দু ধর্মের এক বিশেষ পবিত্র তিথি। এটি ফাল্গুন মাসের শুক্ল পক্ষের একাদশী তিথিতে পালিত হয়। এই দিনটি রঙ্গভরী একাদশী নামেও পরিচিত।
এই একাদশীতে ভগবান বিষ্ণু ও আমলকী গাছের পূজা করা হয়। বিশ্বাস করা হয়, এই দিনে ব্রত পালন করলে জীবনে সুখ, শান্তি ও পাপমোচন হয়।
🪔 একাদশী ব্রতের সংক্ষিপ্ত ধারণা
- হিন্দু ক্যালেন্ডারে প্রতি মাসে দুইটি একাদশী থাকে —
➤ একটি কৃষ্ণ পক্ষের একাদশী
➤ আরেকটি শুক্ল পক্ষের একাদশী - মোট বছরে প্রায় ২৪টি একাদশী পালিত হয়।
 - সব একাদশীই গুরুত্বপূর্ণ হলেও, আমলকী একাদশীকে বিশেষ স্থান দেওয়া হয়েছে কারণ এটি ভগবান বিষ্ণুর প্রিয় তিথি।
 
🌳 আমলকী একাদশীর মাহাত্ম্য
✨ পৌরাণিক বিশ্বাস
পৌরাণিক কাহিনিতে বলা হয়েছে, ভগবান বিষ্ণুর আশীর্বাদে পৃথিবীতে আমলকী গাছের সৃষ্টি হয়েছিল।
এই গাছের প্রতিটি অংশে দেবতার উপস্থিতি রয়েছে। তাই এই গাছকে খুব পবিত্র মনে করা হয়।
🙏 পূজার মাহাত্ম্য
আমলকী একাদশীর দিনে যদি কেউ আমলকী গাছের নিচে বসে বিষ্ণুর নাম জপ করে ও পূজা করে, তাহলে:
- হাজার গোরু দানের সমান পুণ্য অর্জন হয়।
 - জীবনের পাপ মোচন হয়।
 - সংসারে শান্তি ও সমৃদ্ধি আসে।
 
🌸 পূজার উপকারিতা
- ভক্তের মনে শান্তি আসে
 - দীর্ঘায়ু ও স্বাস্থ্য লাভ হয়
 - জীবনের বাধা দূর হয়
 - পরিবারে সৌভাগ্য আসে
 
🌼 আমলকী একাদশীর পূজার নিয়ম
এই দিনে ব্রত পালন করতে কয়েকটি ধাপ অনুসরণ করা হয়:
১️⃣ পূর্বপ্রস্তুতি
- একদিন আগে (দশমী তিথি) থেকে নিয়ম-নিষ্ঠ জীবনযাপন শুরু করতে হয়।
 - মাংস, মদ, রসুন-পেঁয়াজ জাতীয় খাবার পরিহার করা হয়।
 
২️⃣ ব্রতের দিন সকালে
- ভোরে স্নান সেরে বিষ্ণুর নাম জপ করা হয়।
 - ঘরে বা মন্দিরে আমলকী গাছের শাখা এনে রাখা যেতে পারে।
 - ঘি, ফুল, তুলসী পাতা, ধূপ, প্রদীপ দিয়ে পূজা করা হয়।
 
৩️⃣ আমলকী গাছ পূজা
- গাছের গোড়ায় জল ঢালা হয়
 - তুলসী পাতা ও ফুল দিয়ে পূজা করা হয়
 - ভগবান বিষ্ণুর নাম নিয়ে আমলকীর প্রদক্ষিণ করা হয়
 
৪️⃣ সন্ধ্যায় জাগরণ ও ভজন
- রাত্রে ভজন-সন্ধ্যা ও কীর্তন করা হয়।
 - গীতাপাঠ ও বিষ্ণু নামসংকীর্তনে রাত জাগা শুভ বলে ধরা হয়।
 
📖 আমলকী একাদশী ব্রতকথা
🌟 বৈদিশ নগরের গল্প
অনেক কাল আগে বৈদিশ নামে একটি নগর ছিল। সেখানে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র — সব জাতির মানুষ বাস করত।
সবাই বিষ্ণুভক্ত ছিল এবং নিয়মিত একাদশী ব্রত পালন করত।
রাজা ছিলেন চৈতরথ।
তিনি ছিলেন জ্ঞানী, ধার্মিক ও দয়ালু। তাঁর রাজ্যে কেউ দরিদ্র বা অসুখী ছিল না।
সবাই সুখে-শান্তিতে বসবাস করত।
🕉 একাদশীর দিন
একবার ফাল্গুন মাসের আমলকী একাদশী তিথি এলো।
পুরো শহরের মানুষ সেই দিন উপবাস করল।
সন্ধ্যায় সবাই বিষ্ণু মন্দিরে গিয়ে পূজা করল, কীর্তন গাইল এবং সারারাত জেগে রইল।
🌿 শিকারীর আগমন
রাতে এক শিকারী সেখানে এল।
সে ছিল পাপিষ্ঠ ও হিংস্র।
কিন্তু সেদিন সে খুব ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত ছিল।
মন্দিরের এক কোণে বসে সে ভক্তদের জাগরণ দেখছিল।
ভগবান বিষ্ণুর নাম শুনছিল এবং আমলকী একাদশীর মাহাত্ম্য কানে নিচ্ছিল।
🌅 পাপ মোচন
ভোর পর্যন্ত সে জেগে রইল।
যদিও সে নিজে ব্রত রাখেনি, কিন্তু বিষ্ণুর নাম শোনার ফলে ও একাদশীর রাতে জেগে থাকার কারণে তার সমস্ত পাপ ধুয়ে যায়।
পরের দিন সকালে সে বাড়ি গিয়ে খাবার খায় এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই মৃত্যুবরণ করে।
তবে মৃত্যুর পর সে পাপমুক্ত আত্মা হিসেবে স্বর্গে গমন করে।
এই কারণেই বলা হয় —
👉 “যে কেউ আমলকী একাদশীর রাতে জেগে থাকে, বিষ্ণু নাম করে, তার পাপ ধুয়ে যায়।”
🌞 আমলকী একাদশীর গুরুত্ব
আমলকী একাদশী শুধুমাত্র উপবাস নয়, এটি আত্মশুদ্ধির দিন।
💫 ধর্মীয় দিক
- এই দিনে ভগবান বিষ্ণু ও লক্ষ্মী দেবীর আশীর্বাদ লাভ করা যায়।
 - অমৃত ফল অর্থাৎ আমলকী গাছের পূজায় বিশেষ পুণ্য হয়।
 
💫 স্বাস্থ্যগত দিক
- আমলকী বা আমলাকে আয়ুর্বেদে বলা হয় “দিব্য ফল”।
 - এটি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
 - ত্বক ও চুলের জন্যও এটি উপকারী।
 
🍃 আমলকী গাছের আধ্যাত্মিক মানে
আমলকী গাছকে বিষ্ণুর রূপ বলা হয়।
গাছের মূল, কান্ড, পাতা ও ফল — প্রতিটি অংশেই দেবতার উপস্থিতি রয়েছে।
🌿 বিশ্বাস করা হয়:
- এই গাছের নিচে বসে ধ্যান করলে মন শান্ত হয়।
 - জীবনের নেতিবাচক শক্তি দূর হয়।
 - সংসারে সম্পদ ও সমৃদ্ধি আসে।
 
📅 ২০২৫ সালের আমলকী একাদশী তারিখ
- তারিখ: ৩ মার্চ ২০২৫ (সোমবার)
 - তিথি শুরু: ২ মার্চ সন্ধ্যা
 - তিথি শেষ: ৩ মার্চ বিকেল
 - উপবাস ও পূজার মূল দিন: ৩ মার্চ
 
🕯️ আমলকী একাদশীর ব্রতের ফল
এই ব্রত পালন করলে ভক্তরা যে আশীর্বাদ পান:
- পাপ থেকে মুক্তি
 - সংসারে শান্তি
 - রোগমুক্তি ও দীর্ঘ জীবন
 - আত্মিক উন্নতি
 - পরলোকে মুক্তি
 
🌺 আমলকী ফলের ধর্মীয় ব্যবহার
আমলকী ফল শুধু শরীর নয়, আধ্যাত্মিক জীবনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
🍋 ব্যবহার ও প্রতীক
- পূজায় আমলকী ফল ব্যবহার করা শুভ।
 - প্রদীপে আমলকী তেল ব্যবহার করলে মন পরিষ্কার হয়।
 - আমলকীর রস ভগবান বিষ্ণুর প্রিয় নৈবেদ্য।
 
💬 সাধারণ প্রশ্নোত্তর
❓ আমলকী একাদশীতে কী খাওয়া যায়?
উত্তর: সাধারণত ফল, দুধ, পায়েস বা নিরামিষ ভোগ গ্রহণ করা যায়।
যারা উপবাস রাখতে পারেন না, তারা শুধু ফলাহার করেন।
❓ এই দিনে গাছ লাগানো যায় কি?
উত্তর: হ্যাঁ, আমলকী একাদশীতে আমলকী গাছ রোপণ করলে পুণ্য লাভ হয়।
❓ উপবাস না রাখলে কি পাপ হবে?
উত্তর: না, কিন্তু মন থেকে ভগবান বিষ্ণুর নাম স্মরণ করলে একই ফল পাওয়া যায়।
🌼 উপসংহার
আমলকী একাদশী কেবল একটি ব্রত নয়, এটি আত্মশুদ্ধির উৎসব।
এই দিনে ভক্তরা আমলকী গাছের পূজা করে, বিষ্ণুর নাম স্মরণ করে, এবং জীবনের পাপ থেকে মুক্তি পেতে চায়।
আমলকী একাদশী শেখায় —
“যদি তুমি সত্য ভক্তি নিয়ে প্রার্থনা করো, ভগবান নিজে তোমার জীবনে আলো আনবেন।”
✨ মূল বার্তা
আমলকী একাদশী হল ভগবান বিষ্ণুর প্রতি ভক্তি, শুদ্ধতা ও মানবিকতার প্রতীক।
এই দিনে আমলকী গাছের পূজা করে, উপবাস থেকে আত্মশক্তি অর্জন করা যায়।
তাই প্রত্যেক ভক্তের উচিত এই পবিত্র দিনে ভগবানের স্মরণ করা।