তন্ত্রসাধনা আমাদের সংস্কৃতিতে যতটা আধ্যাত্মিকভাবে বিদ্যমান, ততটাই তা গাঁথা রয়েছে বাংলার লোকজীবন, সংস্কৃতি, এমনকি রাজনীতিতেও। “তন্ত্র” শব্দটি বহু মানুষের কাছে রহস্যময় ও ভয়ংকর মনে হলেও বাংলার মাটি তন্ত্রকে শুধু পূজার ক্ষেত্রেই নয়, লোকনাট্য, পালা, লোকাচার ও রাজনীতির ভাষাতেও আত্মস্থ করেছে।
তন্ত্রসাধনার লোকজ শিকড়
বাংলার গ্রামাঞ্চলে চণ্ডী পূজা, শীতলা সাধনা, মঙ্গলকাব্য ইত্যাদির মধ্যে তন্ত্রের ছাপ স্পষ্ট। বাংলার বহু চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে দেবীকে তুষ্ট করতে যে সাধনার বর্ণনা রয়েছে, তা তান্ত্রিক আচারের পরোক্ষ প্রতিফলন।
লোকাচার ও লোকবিশ্বাসে “তান্ত্রিক” ছিলেন দেবতুল্য। রোগভোগ থেকে রক্ষা, জমিতে ফসল আনা, কিংবা অশুভ শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ—সবই তান্ত্রিকের মাধ্যমে সম্ভব বলে ভাবা হতো।
লোকনাট্যে তন্ত্রের রূপ
বাংলার গম্ভীরা, বাউল, জারি-সরিফা, কীর্তন ও যাত্রা – এসব লোকনাট্যে তন্ত্রের উপাদান মিশে রয়েছে।
বাউলরা বলে:
“মনেতে যা ধরো, সেই তো তন্ত্র।”
এই দর্শন অনুযায়ী, আত্মোপলব্ধিই চরম সাধনা। এটি তন্ত্রের আদ্যন্ত মর্ম।
যাত্রাপালায় “অঘোরী তান্ত্রিক”, “কালপুরুষ”, “বামাচারী” চরিত্রগুলো সমাজে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার প্রতীক হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে।
তন্ত্র ও রাজনীতি: ইতিহাসের ছায়াপথে
তন্ত্র শুধু আধ্যাত্মিক বা লোকজ নয়, বাংলার রাজনৈতিক চেতনায়ও প্রভাব ফেলেছে। প্রাচীন যুগে রাজারা তান্ত্রিকদের ব্যবহার করতেন শত্রুর বিরুদ্ধে “শত্রুনাশন যজ্ঞ”, “মারনবিধি” বা “বশীকরণ” করতে।
বামাচারীরা অনেক সময় সমাজের প্রচলিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধাচার করতেন, যা পরবর্তীতে বিদ্রোহী রাজনৈতিক চিন্তাধারায় ছায়া ফেলেছে।
উদাহরণ:
- বামপন্থী আন্দোলনের সময় কিছু নেতার বক্তৃতায় “আত্মচেতনা” এবং “আত্মবল” শব্দের ব্যবহার হয়, যেগুলোর উৎস তান্ত্রিক শব্দমালা।
- সাধক বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী-এর মতো ব্যক্তিত্ব, যিনি ধর্মীয় হলেও ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব পোষণ করতেন, তন্ত্রচর্চা ও সমাজসেবার মধ্যে যোগসূত্র গড়েছেন।
লোকতন্ত্রে তন্ত্রের ভাষা ও প্রতীক
লোকতন্ত্র মানে জনগণের শাসন। জনগণ যেহেতু তন্ত্রকে ভয় করেনি বরং শ্রদ্ধা করেছে, তাই তন্ত্রের প্রতীক, ভাষা ও বিশ্বাসগুলো লোকতান্ত্রিক সংলাপে ঢুকে পড়েছে।
উদাহরণস্বরূপ:
- নেতা বা জনপ্রতিনিধিকে কখনো কখনো “দেবতুল্য” ভাবা — এটি তান্ত্রিক দেবোপাসনার ছায়া।
- অনেক রাজনৈতিক প্রচারে “মাটি”, “মা”, “মায়া” শব্দের ব্যবহার — যা তন্ত্রের মাতৃতত্ত্ব ও শক্তি দর্শনের ছাপ বহন করে।
আধুনিক বাংলায় তন্ত্রচর্চা ও জনমন
আজকের দিনে, যখন সবকিছু বৈজ্ঞানিক যুক্তির আলোয় যাচাই হয়, তখনও বাংলার মানুষের এক বড় অংশ তান্ত্রিক বিশ্বাসে আস্থা রাখেন।
- তারাপীঠ, কামাক্ষ্যা, মায়ং – এই তীর্থগুলোতে হাজার হাজার ভক্ত আসেন।
- সামাজিক ও পারিবারিক সমস্যা নিয়ে এখনও অনেকে তান্ত্রিকের শরণাপন্ন হন।
তাঁরা মনে করেন – যেখানে যুক্তি থেমে যায়, সেখানে শুরু হয় তন্ত্র।
সংস্কৃতির পুঁজি ও আত্মচেতনার জায়গা
তন্ত্র বাংলার সংস্কৃতির এমন এক অংশ, যেটা চেতন-অচেতনের মেলবন্ধন ঘটায়।
যেখানে একদিকে থাকে লোকসংস্কৃতির সাবলীলতা, অন্যদিকে থাকে গভীর অধ্যাত্মচিন্তা। এই দুইয়ের সংমিশ্রণই বাংলার লোকতন্ত্রকে দিয়েছে এক ভিন্ন মাত্রা — ধর্মনিরপেক্ষ অথচ আধ্যাত্মিক চেতনা।