বাংলা বরাবরই এক রহস্যময় ভূমি — নদী, অরণ্য, গুহা ও ঘন গ্রাম্য সংস্কৃতির মধ্যেই গড়ে উঠেছে এক বিশেষ আধ্যাত্মিক ধারা: তন্ত্রসাধনা। এই সাধনার পথ কেবল দেবতা আর মন্ত্রে সীমাবদ্ধ নয়, এর গভীরে রয়েছে আত্মপরীক্ষা, শক্তি উপলব্ধি এবং বহু অলৌকিক তান্ত্রিক কাহিনি, যা কেবল লোকগাথা নয় — বরং প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান।
এই লেখায় আমরা ঘুরে দেখব বাংলার সেই হাজার বছরের পুরনো তান্ত্রিক কাহিনি যা লোকমুখে বেঁচে আছে, কিছু পুরাণে লুকিয়ে আছে, আর কিছু ইতিহাসের চুপচাপ কোণায় ধরা পড়ে।
১. কামারপুকুরের কালুপীর ও সিদ্ধতান্ত্রিক
কামারপুকুরের পাশে এক অখ্যাত গ্রামে বাস করতেন কালুপীর নামে এক সাধক।
তাঁর সম্পর্কে জনশ্রুতি আছে—তিনি তান্ত্রিক শক্তির মাধ্যমে মানুষ, পশু এমনকি প্রকৃতির ঘটনাকেও প্রভাবিত করতে পারতেন।
একবার গ্রামের বন্যা বন্ধ করতে তিনি এক সপ্তাহ ধরে “বৃষ্টিবন্ধন” তন্ত্র জপ করেন।
তখনকার প্রবীণরা বিশ্বাস করতেন, তাঁর জপের মধ্যেই ছিল প্রকৃতির নিয়ন্ত্রণ।
এই কাহিনিতে আমরা পাই প্রকৃত তান্ত্রিকের জনমুখী রূপ — শক্তিকে শুধু নিজের সিদ্ধির জন্য নয়, সমাজের কল্যাণে ব্যবহার।
২. তারাপীঠ ও বামাক্ষ্যাপা: দেবীর সাথে কথোপকথন
তারাপীঠের কাহিনি তান্ত্রিক ইতিহাসে সবচেয়ে পরিচিত। কিন্তু সবচেয়ে বিখ্যাত চরিত্র হলেন বামাক্ষ্যাপা।
জনশ্রুতি অনুযায়ী, তিনি নিয়মিত মা তারা-র সঙ্গে কথা বলতেন — কোনো মধ্যস্থতাকারী ছাড়াই।
একবার তিনি বলেছিলেন:
“মা, তুই চণ্ডাল ঘরে জন্ম নিস না কেন? আমি তোদের সবারে দেখাই, সাধনা জাত দেখে হয় না।”
এই কথার মাঝে ছিল তন্ত্রের মূল দর্শন — বাইরের কিছু নয়, ভেতরের শক্তিই সব।
বামাক্ষ্যাপা শ্মশানে সাধনা করতেন, যেখানে মরা দেহ, নৈশব্দ, এবং ভয় মিলে এক ভিন্ন শক্তিমঞ্চ তৈরি করত। তাঁর জীবনই একটি চলমান তান্ত্রিক মহাগ্রন্থ।
৩. নদিয়ার রহস্যময় “মরণসিদ্ধ” সাধক
নদিয়ার এক নির্জন গ্রামে বাস করতেন এক তান্ত্রিক, যিনি নিজেকে বলতেন “মরণসিদ্ধ।”
তিনি বলতেন, “মরণ না বুঝলে তন্ত্র বোঝা যাবে না।”
জনশ্রুতি অনুযায়ী, তিনি তিন দিন নিজের দেহ মাটি চাপা দিয়ে রাখতেন, তারপর চতুর্থ দিনে উঠে আসতেন ধ্যান ভেঙে।
স্থানীয়ভাবে মানুষ বিশ্বাস করত—তিনি মৃত্যুর পরবর্তীতে প্রবেশ করেছিলেন এবং আবার ফিরে এসেছেন।
তাঁর কথা থেকে বোঝা যায়, তন্ত্রে মৃত্যুও একটি অনুশীলন — একরকম জাগরণের পথ।
৪. লোককাহিনিতে “ডাকিনী–যোগিনী”
বাংলার বহু লোকগাথায় ডাকিনী–যোগিনী বা অদৃশ্য শক্তির কথা পাওয়া যায়।
বিশেষ করে পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম অঞ্চলে “ভৈরব সাধনা”, “ভাণ্ডার সাধনা”, “যোগিনীমাতা” ইত্যাদি বিষয় বহু মানুষের বিশ্বাসে রয়ে গেছে।
কোনো কোনো গল্পে দেখা যায়,
- রাতের বেলায় শ্মশানে বা গাছতলায় একা গিয়ে তান্ত্রিক ধ্যান করলে যোগিনীরা আসেন
- তারা পরীক্ষাও নেন সাধকের সাহস, একাগ্রতা ও কামনাবর্জন নিয়ে
এই কাহিনিগুলোর মর্মে আছে — সাধনায় ভয় জয় করাই প্রথম চাবিকাঠি।
৫. মায়ং: জাদুবিদ্যার হারানো অধ্যায়
আসাম–বাংলা সীমানায় অবস্থিত মায়ং — একসময় ছিল জাদুবিদ্যার রাজধানী।
সেখানে বহু বাঙালি তান্ত্রিক সাধক গিয়ে সাধনা করতেন।
লোককথা বলে,
- সেখানে কেউ একজন পাথরকে মানুষ বানিয়েছিলেন
- কেউ বাতাসে উড়ে গিয়েছিলেন
- কেউ মৃতকে জীবিত করেছিলেন
এইসব গল্প শুনে হয়তো আধুনিক মন অস্বীকার করবে, কিন্তু ঐ অঞ্চলের মানুষ আজও বিশ্বাস করেন, তন্ত্র শুধু চর্চা নয়, বাস্তবের রূপান্তর।
৬. বাংলার নারী তান্ত্রিকদের ইতিহাস
অনেকেই জানেন না যে বাংলায় একাধিক নারী ছিলেন যাঁরা তন্ত্রসাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছিলেন।
- মণিমালা দেবী নামে এক সাধ্বী বীরভূমে একা শ্মশানে ধ্যান করতেন
- রানি রসোমণি স্বপ্নে মা কালী থেকে তান্ত্রিক নির্দেশ পেয়ে কালীঘাট মন্দির সংস্কার করেছিলেন
- কিছু নারী ছিলেন যাঁরা কুলাচার বা শ্রীবিদ্যার অনুশীলন করতেন গোপনে, সমাজের বাধা উপেক্ষা করে
তাঁদের গল্প আজ হারিয়ে গেলেও, তারা প্রমাণ করেন তন্ত্র নারী–পুরুষ বিভাজন নয়, আত্মিক শক্তির পথ।
এইসব হাজার বছরের পুরনো তান্ত্রিক কাহিনি কেবল গল্প নয় — এগুলো বাংলার চেতনা, সাহস, এবং আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানের রূপরেখা। আধুনিক সময়ে এসে আমরা যদি শুধুই বিজ্ঞানের আলোয় এগুলি বাতিল করি, তাহলে হারিয়ে ফেলব আমাদের আত্মপরিচয়ের এক গভীর অধ্যায়।
তন্ত্র মানেই অশুভ নয়, তন্ত্র মানেই অন্ধকার নয় — বরং আত্মশক্তিকে জানার এক গভীর যাত্রা। আর সেই যাত্রার কিছু নিদর্শন বাংলার ইতিহাস, লোককথা আর সাধকদের মধ্যে আজও বেঁচে আছে।